বর্তমান ডিজিটাল যুগে কম্পিউটার আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। অফিসের কাজ থেকে শুরু করে অনলাইন ব্যাংকিং, শিক্ষালাভ, বিনোদন – সবকিছুই কম্পিউটারের মাধ্যমে সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু এই সুবিধার পাশাপাশি রয়েছে এক বড় হুমকি—কম্পিউটার ভাইরাস। অনেকেই শুনেছেন এই শব্দটি, কিন্তু সত্যিকার অর্থে “কম্পিউটার ভাইরাস কি?”, এটি কীভাবে ছড়ায় বা কী ধরনের ক্ষতি করে – তা অনেকের কাছেই এখনও অস্পষ্ট।
এই আর্টিকেলে আমরা সহজ ভাষায় বুঝিয়ে দেব কম্পিউটার ভাইরাস কী, এর প্রকারভেদ, ভাইরাসে আক্রান্ত কম্পিউটারের লক্ষণ, এবং কীভাবে আপনি নিজের ডিভাইসকে এই বিপজ্জনক সফটওয়্যার থেকে নিরাপদ রাখতে পারেন। আপনি যদি একজন সাধারণ ব্যবহারকারী হন বা প্রযুক্তি সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হন – এই গাইডটি আপনার জন্যই!
কম্পিউটার ভাইরাস কি?
কম্পিউটার ভাইরাস হলো এক ধরনের ম্যালিসিয়াস সফটওয়্যার বা ম্যালওয়্যার, যা নিজেকে অন্য প্রোগ্রাম বা ফাইলের ভিতরে লুকিয়ে রাখতে পারে এবং একটি ডিভাইসে প্রবেশ করার পর ধীরে ধীরে নিজেকে ছড়িয়ে দেয়। এটি মূলত এমন একটি কোড যা ব্যবহারকারীর অনুমতি ছাড়াই কম্পিউটারে চলতে থাকে এবং নানা ধরনের ক্ষতি করতে পারে – যেমন ফাইল মুছে ফেলা, ডেটা নষ্ট করা, পারফরম্যান্স ধীর করে দেওয়া অথবা পুরো সিস্টেম অচল করে ফেলা।
কম্পিউটার ভাইরাসের কাজ অনেকটা মানুষের দেহে ছড়িয়ে পড়া ভাইরাসের মতো। যেমন দেহে ভাইরাস ঢুকলে জ্বর বা দুর্বলতা দেখা দেয়, ঠিক তেমনই কম্পিউটারে ভাইরাস প্রবেশ করলে অস্বাভাবিক কার্যকলাপ শুরু হয়—যেমন: প্রোগ্রাম হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়া, অপ্রত্যাশিত পপ-আপ আসা, বা গুরুত্বপূর্ণ ফাইল হারিয়ে যাওয়া।
সহজ ভাষায় কম্পিউটার ভাইরাস এক ধরনের “ডিজিটাল রোগ”, যা একবার পিসিতে ঢুকলে তা নিজে নিজে ছড়িয়ে পড়ে এবং ডিভাইসের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা নষ্ট করে দেয়।
কম্পিউটার ভাইরাস কীভাবে কাজ করে?
কম্পিউটার ভাইরাস সাধারণত একটি নির্দিষ্ট প্রোগ্রামের বা ফাইলের ভিতরে লুকিয়ে থাকে এবং ব্যবহারকারীর কোনো অ্যাকশন (যেমন: ফাইল ওপেন করা বা সফটওয়্যার চালু করা) এর মাধ্যমে সক্রিয় হয়। একবার সক্রিয় হলে এটি নিজেকে অন্যান্য ফাইল, সফটওয়্যার, এমনকি ইউএসবি ড্রাইভ বা ইমেইলের মাধ্যমেও ছড়িয়ে দিতে পারে।
ভাইরাসের কাজের ধাপগুলো:
১. সংক্রমণ (Infection):
ভাইরাস প্রথমে একটি নির্দিষ্ট ফাইল বা সফটওয়্যারের সঙ্গে যুক্ত হয়। এটি ব্যবহারকারী বুঝতেই পারে না কারণ ভাইরাস নিজেকে “লুকিয়ে” রাখতে পারে।
২. সক্রিয় হওয়া (Activation):
ব্যবহারকারী যখন ওই ইনফেক্টেড ফাইল চালু করে, তখন ভাইরাস সক্রিয় হয় এবং কম্পিউটারের মেমোরিতে ঢুকে পড়ে।
৩. প্রসার (Replication):
সক্রিয় হওয়ার পর ভাইরাস নিজেকে অন্যান্য ফাইলে কপি করে এবং ধীরে ধীরে পুরো সিস্টেমে ছড়িয়ে পড়ে।
৪. ক্ষতি (Payload Execution):
একবার সিস্টেমে ছড়িয়ে গেলে ভাইরাস তার ক্ষতিকর কাজ শুরু করে—যেমন ফাইল মুছে ফেলা, পাসওয়ার্ড চুরি, সিস্টেম স্লো করে ফেলা, বা হ্যাকারদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যাওয়া।
উদাহরণ:
ধরুন, আপনি ইমেইলের মাধ্যমে একটি ফ্রি গেম ডাউনলোড করলেন। সেটি চালু করতেই ভাইরাস অ্যাক্টিভ হয়ে গেল। এরপর এটি আপনার কম্পিউটারের গুরুত্বপূর্ণ ফাইলগুলো নষ্ট করতে শুরু করলো এবং ইন্টারনেটের মাধ্যমে অন্যদের কাছেও ছড়িয়ে পড়তে লাগলো।
কম্পিউটার ভাইরাসের প্রকারভেদ
কম্পিউটার ভাইরাস একধরনের নয়। এটি বিভিন্ন রকমের হতে পারে, এবং প্রতিটি ভাইরাসের কার্যপদ্ধতি ও ক্ষতিকর প্রভাব ভিন্ন। নিচে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ও প্রচলিত ভাইরাসের প্রকারভেদ দেওয়া হলো:
১. ফাইল ইনফেক্টর ভাইরাস (File Infector Virus)
এই ধরণের ভাইরাস বিভিন্ন এক্সিকিউটেবল ফাইল (.exe বা .com) কে সংক্রমিত করে। ব্যবহারকারী যখন ইনফেক্টেড ফাইল চালায়, ভাইরাস সক্রিয় হয়ে ছড়িয়ে পড়ে।
উদাহরণ: “Vienna virus”
২. বুট সেক্টর ভাইরাস (Boot Sector Virus)
এই ভাইরাস হার্ড ডিস্ক বা ফ্ল্যাশ ড্রাইভের বুট সেক্টরে আক্রমণ করে, যেখান থেকে কম্পিউটার চালু হয়। এটি সিস্টেম অন করার সময়ই সক্রিয় হয়ে পড়ে।
উদাহরণ: “Stone virus”
৩. ট্রোজান হর্স (Trojan Horse)
ট্রোজান নিজে ভাইরাস না হলেও অত্যন্ত বিপজ্জনক। এটি একটি নিরীহ প্রোগ্রামের মতো মনে হয়, কিন্তু একবার ইনস্টল করলে হ্যাকারদের পিসিতে প্রবেশের সুযোগ করে দেয়।
উদাহরণ: “Zeus Trojan”
৪. ওয়ার্ম (Worm)
ওয়ার্ম ভাইরাস নিজে নিজেই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে এক ডিভাইস থেকে অন্য ডিভাইসে ছড়িয়ে পড়ে। এটি সংক্রমণের জন্য ব্যবহারকারীর কোনো কাজের দরকার হয় না।
উদাহরণ: “ILOVEYOU worm”
৫. র্যানসমওয়্যার (Ransomware)
এই ভাইরাস ফাইল এনক্রিপ্ট করে ব্যবহারকারীকে ব্ল্যাকমেইল করে অর্থ (ransom) দাবি করে। যতক্ষণ না অর্থ দেওয়া হয়, ফাইলগুলো আনলক হয় না।
উদাহরণ: “WannaCry”
৬. স্পাইওয়্যার (Spyware)
স্পাইওয়্যার গোপনে আপনার কম্পিউটারে ইনস্টল হয়ে আপনার কার্যক্রম নজরদারি করে—যেমন: কী টাইপ করছেন, কোন ওয়েবসাইট দেখছেন, পাসওয়ার্ড কী ইত্যাদি।
উদাহরণ: “CoolWebSearch”
প্রত্যেক ধরণের ভাইরাসের নিজস্ব আক্রমণ কৌশল থাকে। তাই এগুলোর প্রকারভেদ জানলে আপনি সচেতনভাবে ভাইরাস প্রতিরোধে প্রস্তুত থাকতে পারবেন।
কম্পিউটার ভাইরাসের লক্ষণ ও ক্ষতি
কম্পিউটার ভাইরাসে আক্রান্ত হলে অনেক সময় ব্যবহারকারীরা বুঝতেই পারেন না যে ডিভাইসটি সংক্রমিত হয়েছে। কিন্তু কিছু স্পষ্ট লক্ষণ ও পরিবর্তনের মাধ্যমে আপনি বুঝতে পারবেন যে আপনার পিসি বা ল্যাপটপ ভাইরাসে আক্রান্ত। নিচে তার কিছু সাধারণ লক্ষণ ও ক্ষতিকর প্রভাব তুলে ধরা হলো:
কম্পিউটার ভাইরাসের সাধারণ লক্ষণসমূহ:
১. অস্বাভাবিক ধীর গতি
কম্পিউটার হঠাৎ করে অত্যন্ত স্লো হয়ে যায়, প্রোগ্রাম চালু হতে সময় নেয়, বা হ্যাং হয়ে যায়।
২. অপ্রত্যাশিত পপ-আপ ও বার্তা
ইন্টারনেট ব্রাউজ করার সময় হঠাৎ করে নানা ধরনের বিজ্ঞাপন, এলার্ট, বা ভুয়া অ্যান্টিভাইরাস মেসেজ দেখা যায়।
৩. ফাইল হারিয়ে যাওয়া বা পরিবর্তিত হওয়া
ফাইল নিজে নিজে ডিলিট হয়ে যায় অথবা নাম ও কনটেন্ট পরিবর্তিত হয়ে যায়।
৪. স্বয়ংক্রিয় সফটওয়্যার ইনস্টলেশন
আপনি ইনস্টল করেননি এমন সফটওয়্যার বা টুলবার হঠাৎ করে কম্পিউটারে এসে যায়।
৫. অস্বাভাবিক নেটওয়ার্ক ট্রাফিক
ইন্টারনেট ডেটা অতিরিক্ত খরচ হতে থাকে এবং ব্যাকগ্রাউন্ডে অনেক অজানা প্রসেস চলে।
৬. কম্পিউটার নিজে নিজে রিস্টার্ট / ক্র্যাশ হওয়া
সিস্টেম বারবার বন্ধ হয়ে যায় বা রিস্টার্ট হয় কোনো কারণ ছাড়াই।
কম্পিউটার ভাইরাসের সম্ভাব্য ক্ষতি:
- গুরুত্বপূর্ণ ফাইল ও ডেটা হারিয়ে যেতে পারে
- ব্যক্তিগত তথ্য (পাসওয়ার্ড, ব্যাংক ডিটেলস) চুরি হয়ে যেতে পারে
- কম্পিউটার সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে যেতে পারে
- অন্য কম্পিউটারেও ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে
- হ্যাকারদের দ্বারা রিমোট কন্ট্রোল হয়ে যেতে পারে
যদি আপনি উপরোক্ত লক্ষণগুলোর এক বা একাধিক দেখতে পান, তাহলে দ্রুত অ্যান্টিভাইরাস দিয়ে স্ক্যান করুন এবং প্রয়োজনে একজন আইটি বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিন।
ভাইরাস কীভাবে ছড়ায়?
কম্পিউটার ভাইরাস সাধারণত বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে এক ডিভাইস থেকে অন্য ডিভাইসে ছড়িয়ে পড়ে। অনেক সময় ব্যবহারকারী বুঝতেই পারে না যে সে নিজের অজান্তেই ভাইরাস ছড়িয়ে দিচ্ছে বা নিজের কম্পিউটারকে সংক্রমিত করছে।
ভাইরাস ছড়ানোর প্রধান কয়েকটি উপায় নিচে তুলে ধরা হলো:
১. ইমেইল অ্যাটাচমেন্ট ও ফিশিং লিঙ্ক
ভাইরাসযুক্ত ফাইল অনেক সময় ইমেইলের সঙ্গে অ্যাটাচ করে পাঠানো হয়। এগুলোর মধ্যে থাকে .exe, .zip বা .doc ফাইল যা খুললেই ভাইরাস সক্রিয় হয়ে যায়। অনেক সময় আবার ভুয়া ইমেইলে থাকা লিঙ্কে ক্লিক করলেও ভাইরাস প্রবেশ করতে পারে।
২. সফটওয়্যার ডাউনলোড (বিশ্বাসযোগ্য নয় এমন উৎস থেকে)
ক্র্যাকড বা পাইরেটেড সফটওয়্যার ডাউনলোড করার মাধ্যমে ভাইরাস কম্পিউটারে প্রবেশ করতে পারে। কিছু ফ্রি সফটওয়্যারও ভাইরাস বা অ্যাডওয়্যারের বাহক হতে পারে।
৩. ইউএসবি ড্রাইভ ও এক্সটারনাল ডিভাইস
ইনফেক্টেড পেনড্রাইভ, হার্ডড্রাইভ বা মেমোরি কার্ড ব্যবহারের মাধ্যমে ভাইরাস ছড়ায় খুব সহজেই। একবার ইনফেক্টেড ডিভাইস সংযুক্ত করলেই ভাইরাস কম্পিউটারে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
৪. সংক্রমিত ওয়েবসাইট ভিজিট করা
কিছু ওয়েবসাইটে (বিশেষ করে পর্ন, হ্যাকিং, অথবা ফ্রি ডাউনলোড সাইট) ভাইরাস কোড এমবেড করা থাকে। সেখানে প্রবেশ করলেই ভাইরাস স্বয়ংক্রিয়ভাবে ব্রাউজারের মাধ্যমে ডিভাইসে ইনস্টল হয়ে যেতে পারে।
৫. নেটওয়ার্ক সংযোগ
একই নেটওয়ার্কে থাকা একাধিক কম্পিউটার ভাইরাসের মাধ্যমে একে অপরকে সংক্রমিত করতে পারে, বিশেষ করে যদি ফায়ারওয়াল বা নিরাপত্তা ব্যবস্থা দুর্বল থাকে।
৬. সোশ্যাল মিডিয়া ও চ্যাট অ্যাপস
ভাইরাস এখন মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, বা অন্যান্য চ্যাট প্ল্যাটফর্মেও ছড়ায়—ভুয়া ভিডিও লিঙ্ক, ছবি, বা অ্যাপ্লিকেশন আকারে।
তাই কী করবেন?
- অপরিচিত ইমেইল বা ফাইল খুলবেন না
- সবসময় বিশ্বস্ত উৎস থেকে সফটওয়্যার ডাউনলোড করুন
- ইউএসবি ব্যবহারের সময় অটো-রান বন্ধ রাখুন
- ভালো অ্যান্টিভাইরাস ব্যবহার করে নিয়মিত স্ক্যান করুন
পরবর্তী অংশে আমরা আলোচনা করব—“কম্পিউটার ভাইরাস থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায়”, যাতে আপনি নিরাপদ ও সচেতন থাকতে পারেন।
কম্পিউটার ভাইরাস থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায়
কম্পিউটার ভাইরাস থেকে সম্পূর্ণরূপে নিরাপদ থাকা সম্ভব হলেও এর জন্য প্রয়োজন সচেতনতা, নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ এবং নিরাপদ প্রযুক্তি ব্যবহার। নিচে ভাইরাস থেকে নিজেকে ও আপনার ডিভাইসকে রক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু কার্যকর উপায় দেওয়া হলো:
১. আপডেটেড অ্যান্টিভাইরাস ব্যবহার করুন
আপনার কম্পিউটারে অবশ্যই একটি বিশ্বস্ত ও হালনাগাদ অ্যান্টিভাইরাস সফটওয়্যার থাকতে হবে। এটি রিয়েল-টাইমে ভাইরাস শনাক্ত করে ব্লক করতে পারে।
প্রস্তাবিত কিছু অ্যান্টিভাইরাস:
- Bitdefender
- Kaspersky
- Norton
- Windows Defender (মাঝারি সুরক্ষার জন্য ভালো)
২. নিয়মিত সফটওয়্যার ও অপারেটিং সিস্টেম আপডেট করুন
ভাইরাস অনেক সময় পুরনো সফটওয়্যারের দুর্বলতাকে ব্যবহার করে প্রবেশ করে। তাই Windows, ব্রাউজার, এবং অন্যান্য অ্যাপস নিয়মিত আপডেট রাখা গুরুত্বপূর্ণ।
৩. অপরিচিত লিঙ্ক, ইমেইল ও ফাইল এড়িয়ে চলুন
কোনো অচেনা ইমেইল বা মেসেজে থাকা লিঙ্ক বা অ্যাটাচমেন্টে ক্লিক করা থেকে বিরত থাকুন। এগুলো ফিশিং বা ভাইরাস ছড়ানোর অন্যতম উপায়।
৪. ফায়ারওয়াল সক্রিয় রাখুন
ফায়ারওয়াল ইনকামিং ও আউটগোয়িং ট্রাফিক পর্যবেক্ষণ করে এবং সন্দেহজনক সংযোগকে ব্লক করে, যা ভাইরাস প্রতিরোধে সহায়ক।
৫. ইউএসবি ব্যবহার করার আগে স্ক্যান করুন
যেকোনো পেনড্রাইভ বা এক্সটারনাল ড্রাইভ ব্যবহারের আগে অ্যান্টিভাইরাস দিয়ে স্ক্যান করুন। অটো-রান অপশন বন্ধ রাখলে আরও ভালো।
৬. নিয়মিত ব্যাকআপ নিন
ভাইরাস আক্রমণে ডেটা হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। তাই গুরুত্বপূর্ণ ফাইলগুলো ক্লাউড বা এক্সটারনাল স্টোরেজে ব্যাকআপ রাখুন।
৭. নিরাপদ ওয়েবসাইট ব্যবহার করুন
সবসময় SSL সুরক্ষিত (https://) ও বিশ্বস্ত ওয়েবসাইটে ব্রাউজ করুন। সন্দেহজনক বা অবৈধ কনটেন্ট থেকে দূরে থাকুন।
সংক্ষিপ্ত টিপস:
- Pop-up blocker চালু রাখুন
- Admin privilege সীমিত ব্যবহার করুন
- ম্যালওয়্যার ব্লকার এক্সটেনশন ব্যবহার করুন (যেমন: Malwarebytes Browser Guard)
যদি কম্পিউটার ভাইরাসে আক্রান্ত হয়, তাহলে কী করবেন?
যদি আপনার মনে হয় আপনার কম্পিউটার ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে, তাহলে আতঙ্কিত না হয়ে ঠাণ্ডা মাথায় কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। নিচে ধাপে ধাপে করণীয়গুলো উল্লেখ করা হলো, যা আপনার ডিভাইসকে ভাইরাস থেকে মুক্ত করতে সাহায্য করবে।
১. ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করুন
ভাইরাস অনেক সময় ইন্টারনেট ব্যবহার করে ডেটা চুরি করে বা অন্য ডিভাইসে ছড়িয়ে পড়ে। তাই প্রথমেই আপনার Wi-Fi বা ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করুন।
২. কম্পিউটারকে Safe Mode-এ চালু করুন
Safe Mode-এ উইন্ডোজ কম জরুরি প্রোগ্রাম চালায়, ফলে ভাইরাস অ্যাক্টিভ হতে পারে না। এতে ভাইরাস শনাক্ত ও মুছে ফেলা সহজ হয়।
Windows এ Safe Mode চালু করতে:
Restart দিন → Boot screen আসলে F8 বা Shift+Restart চাপুন → Safe Mode নির্বাচন করুন।
৩. পূর্ণাঙ্গ অ্যান্টিভাইরাস স্ক্যান চালান
আপনার নির্ভরযোগ্য অ্যান্টিভাইরাস সফটওয়্যার দিয়ে ফুল স্ক্যান চালান। শুধু Quick Scan যথেষ্ট নয় — Deep Scan বা Full Scan ভাইরাস সঠিকভাবে ধরতে পারে।
৪. সন্দেহজনক প্রোগ্রাম বা ফাইল আনইনস্টল/ডিলিট করুন
Control Panel বা Task Manager থেকে এমন সফটওয়্যার খুঁজে বের করুন যেগুলো আপনি নিজে ইনস্টল করেননি বা অজানা। সেগুলো রিমুভ করুন।
৫. সিস্টেম রিস্টোর ব্যবহার করুন (যদি সম্ভব হয়)
আপনি যদি পূর্বে একটি রিস্টোর পয়েন্ট তৈরি করে থাকেন, তাহলে সিস্টেমকে সেই অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারেন – এটি ভাইরাস রিমুভে কার্যকর হতে পারে।
৬. পেশাদার আইটি সহায়তা নিন (গুরুতর ক্ষেত্রে)
যদি ভাইরাস অত্যন্ত জটিল বা র্যানসমওয়্যার টাইপের হয় এবং আপনি নিজে সমাধান করতে না পারেন, তাহলে বিশেষজ্ঞের সাহায্য নেওয়াই ভালো।
অতিরিক্ত সতর্কতা:
- ভাইরাস মুছে ফেলার পর ব্রাউজার ক্যাশ ও cookies ক্লিয়ার করুন
- সব পাসওয়ার্ড পরিবর্তন করুন
- ভবিষ্যতের জন্য রেগুলার ব্যাকআপ রাখার অভ্যাস গড়ে তুলুন
এই ধাপগুলো অনুসরণ করলে ভাইরাস আক্রান্ত কম্পিউটারকে অনেকটাই নিরাপদ ও পরিষ্কার করা সম্ভব।
কম্পিউটার ভাইরাস বনাম ম্যালওয়্যার: পার্থক্য কী?
অনেকেই মনে করেন কম্পিউটার ভাইরাস এবং ম্যালওয়্যার একই জিনিস। কিন্তু বাস্তবে, ভাইরাস ম্যালওয়ারের একটি নির্দিষ্ট ধরন মাত্র। সব ভাইরাস ম্যালওয়্যার হলেও, সব ম্যালওয়্যার ভাইরাস নয়। নিচে আমরা বিস্তারিতভাবে পার্থক্য ব্যাখ্যা করছি:
কম্পিউটার ভাইরাস কী?
কম্পিউটার ভাইরাস এমন একটি প্রোগ্রাম যা নিজেকে অন্য ফাইলে সংযুক্ত করে এবং ব্যবহারকারীর কোনো অ্যাকশনের মাধ্যমে সক্রিয় হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। এর কাজ হল নিজেকে কপি করে বিভিন্ন ফাইল বা সিস্টেমে সংক্রমণ ঘটানো।
মূল বৈশিষ্ট্য:
- নিজেকে রিপ্লিকেট করতে পারে
- ফাইল বা সফটওয়্যারের মাধ্যমে ছড়ায়
- ব্যবহারকারীর ইনপুট দরকার হয় সক্রিয় হতে
ম্যালওয়্যার কী?
ম্যালওয়্যার শব্দটি এসেছে “Malicious Software” থেকে—যার অর্থ ক্ষতিকর সফটওয়্যার। এটি এমন সব সফটওয়্যারের সাধারণ নাম যেগুলো কম্পিউটারে অনধিকার প্রবেশ করে ক্ষতি করে।
ম্যালওয়্যারের প্রকারভেদ:
- ভাইরাস (Virus)
- ওয়ার্ম (Worm)
- ট্রোজান (Trojan)
- র্যানসমওয়্যার (Ransomware)
- স্পাইওয়্যার (Spyware)
- অ্যাডওয়্যার (Adware)
- কী-লগার (Keylogger)
- রুটকিট (Rootkit)
মূল বৈশিষ্ট্য:
- ভাইরাস ছাড়াও অন্যান্য অনেক রকম সফটওয়্যার অন্তর্ভুক্ত
- নানা কৌশলে ছড়াতে পারে (নেটওয়ার্ক, ইউএসবি, ফিশিং ইত্যাদি)
- কিছু ম্যালওয়্যার গোপনে কাজ করে, ব্যবহারকারী টেরও পায় না
তুলনামূলক চিত্র (সারাংশ):
দিক | কম্পিউটার ভাইরাস | ম্যালওয়্যার |
সংজ্ঞা | একটি ক্ষতিকর প্রোগ্রাম যা নিজেকে কপি করে | সব ধরনের ক্ষতিকর সফটওয়্যারকে একত্রে বলা হয় |
ছড়ানোর পদ্ধতি | ইনফেক্টেড ফাইল বা সফটওয়্যারের মাধ্যমে | ফাইল, নেটওয়ার্ক, ওয়েবসাইট, ইমেইল ইত্যাদি |
ধরন | ম্যালওয়্যারের একটি ধরন | একটি ছাতার নিচে থাকা বিভিন্ন ভাইরাস টাইপ |
ব্যবহারকারীর ভূমিকা | দরকার (যেমন: ফাইল চালানো) | কখনো দরকার হয়, কখনো হয় না (ওয়ার্ম, ট্রোজান) |
কম্পিউটার ভাইরাস হলো ম্যালওয়্যার পরিবারের একটি সদস্য। ভাইরাস সাধারণত নিজে নিজে ছড়িয়ে পড়ে এবং ব্যবহারকারীর ফাইল নষ্ট করে দেয়, আর ম্যালওয়্যার হতে পারে আরও অনেক ধরণের – যেগুলোর কিছু আপনার তথ্য চুরি করে, কিছু আবার পুরো সিস্টেমই লক করে দেয়।
তাই শুধু ভাইরাস নয়, সকল ম্যালওয়্যার থেকে সাবধান থাকা এবং সম্পূর্ণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
কম্পিউটার ভাইরাস নিয়ে সাধারণ প্রশ্নোত্তর (FAQ)
প্রশ্ন: কম্পিউটার ভাইরাস কী?
উত্তর: কম্পিউটার ভাইরাস হলো একটি ক্ষতিকর সফটওয়্যার প্রোগ্রাম যা নিজেকে কপি করে অন্য ফাইলে বা প্রোগ্রামে ঢুকে পড়ে এবং কম্পিউটারে নানাভাবে ক্ষতি করে—যেমন ফাইল মুছে ফেলা, পারফরম্যান্স স্লো করে ফেলা বা ডেটা চুরি।
প্রশ্ন: কিভাবে বুঝব আমার কম্পিউটার ভাইরাসে আক্রান্ত?
উত্তর: কম্পিউটার স্লো হয়ে যাওয়া, অপ্রত্যাশিত পপ-আপ, অজানা সফটওয়্যার ইনস্টল হওয়া, ফাইল হারিয়ে যাওয়া বা কম্পিউটার নিজে নিজে রিস্টার্ট হওয়া—এসবই ভাইরাস সংক্রমণের লক্ষণ।
প্রশ্ন: কম্পিউটার ভাইরাস মোবাইলেও আসে কি?
উত্তর: হ্যাঁ, অ্যান্ড্রয়েড ও iOS ডিভাইসেও ভাইরাস বা ম্যালওয়্যার আসতে পারে। বিশেষ করে সন্দেহজনক অ্যাপ ডাউনলোড বা লিঙ্কে ক্লিক করলে মোবাইল ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে।
প্রশ্ন: ফ্রি অ্যান্টিভাইরাস কি নিরাপদ?
উত্তর: বিশ্বস্ত কোম্পানির ফ্রি অ্যান্টিভাইরাস (যেমন: Avast, AVG, Windows Defender) সাধারণ নিরাপত্তা দেয়, তবে প্রিমিয়াম সংস্করণে আরও উন্নত সুরক্ষা থাকে। অজানা ফ্রি অ্যান্টিভাইরাস এড়িয়ে চলা ভালো।
প্রশ্ন: উইন্ডোজ ডিফেন্ডার কি যথেষ্ট?
উত্তর: সাধারণ ব্যবহারের জন্য Windows Defender একটি ভালো ফ্রি অ্যান্টিভাইরাস টুল। তবে আপনি যদি ইন্টারনেট থেকে অনেক ফাইল ডাউনলোড করেন বা ঝুঁকিপূর্ণ ওয়েবসাইটে ভিজিট করেন, তাহলে একটি শক্তিশালী থার্ড-পার্টি অ্যান্টিভাইরাস ব্যবহার করা ভালো।
প্রশ্ন: ভাইরাস থাকলে কি সব ফাইল হারিয়ে যাবে?
উত্তর: সব ভাইরাস ফাইল ডিলিট করে না, তবে কিছু র্যানসমওয়্যার বা ডেস্ট্রাকটিভ ভাইরাস আপনার গুরুত্বপূর্ণ ডেটা চিরতরে মুছে দিতে পারে। তাই নিয়মিত ব্যাকআপ রাখা অত্যন্ত জরুরি।
শেষ কথা: সচেতনতাই কম্পিউটার ভাইরাস প্রতিরোধের মূল চাবিকাঠি
বর্তমান প্রযুক্তিনির্ভর যুগে কম্পিউটার ভাইরাস একটি বাস্তব ও বড় হুমকি। এটি শুধু আপনার ডিভাইসের ক্ষতি করে না, বরং আপনার ব্যক্তিগত তথ্য, গোপন ফাইল এবং অনলাইন নিরাপত্তাও ঝুঁকিতে ফেলে দেয়। তবে আশার কথা হলো—যথাযথ জ্ঞান, সচেতনতা এবং নিরাপদ ব্যবহার অভ্যাস গড়ে তুললে এই বিপদ সহজেই প্রতিরোধ করা সম্ভব।
এই আর্টিকেলে আমরা জানলাম কম্পিউটার ভাইরাস কি, এর কাজ করার পদ্ধতি, ভিন্ন ভিন্ন ধরন, লক্ষণ ও ক্ষতি, এবং রক্ষা পাওয়ার উপায় সহ ভাইরাস সংক্রমণের পর কী করতে হবে। এছাড়াও, ভাইরাস ও ম্যালওয়্যারের মধ্যে পার্থক্য এবং পাঠকের সাধারণ প্রশ্নগুলোর উত্তরও তুলে ধরা হয়েছে।
স্মরণ রাখুন—আপনার কম্পিউটার বা মোবাইল ডিভাইস ঠিক ততটাই নিরাপদ, যতটা আপনি সচেতন।
নিজের প্রযুক্তি নিরাপত্তা নিজেই নিশ্চিত করুন। জেনে, বুঝে, নিরাপদ থাকুন!